আপনার মৃত্যু হবে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!


মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবেন আপনি,

 হুবহু আপনার মতো চেহারার ও অভিব্যক্তির নকল 'আপনি'র মাধ্যমে। কীভাবে?

চার বছর বয়সী এমা একদিন খেলাচ্ছলে তার আইপ্যাডের 'সিরি'-কে অন করে বসে।
 সিরির কণ্ঠ শোনামাত্রই তার চোখেমুখে জেগে ওঠে কৌতূহল। সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, "আব্বু, এটা কী?" 
"ওর নাম সিরি।
 তুমি চাইলে কথা বলতে পারো ওর সাথে," জবাব দেন বাবা।  


আপনার মৃত্যু হবে না  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়  বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!

সিরির কাছে শিশুটির প্রথম প্রশ্ন ছিল তার মা আছে কি না। এরপর বাচ্চারা সাধারণত যেসব প্রশ্ন করে, সেসব প্রশ্নই আসতে থাকে তার মুখ থেকে-—"তুমি আইসক্রিম পছন্দ করো?",

 "খেলনা পছন্দ করো?"

এমার বাবা, এমিল হিমেনেথ আবার পড়াশোনা করেছেন মনোবিজ্ঞানে। তিনি খেয়াল করেন, সিরির সঙ্গে খুব দ্রুত সম্পর্ক গড়ে তুলছে তার চার বছর বয়সী সন্তান। একদিনের কথোপকথনেই সিরিকে 'প্রিয় বন্ধু' ঘোষণা করে বসে এমা। 

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) সঙ্গে মেয়ের এই স্বচ্ছন্দ যোগাযোগ দেখে হিমেনেথের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে যায়। 

"আজ আমার মেয়ে সিরির সঙ্গে কথা বলে। আমি চাই ভবিষ্যতের কোনো একদিন সে আমার সাথেও এভাবে কথা বলুক। কারণ আমি জানি আমি চিরকাল এই পৃথিবীতে থাকতে পারব না", বলেন হিমেনেথ। 

"আমি আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। যদি আমি এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারি, যার মাধ্যমে সবসময়ই তাকে সাহায্য করতে পারব, তাহলে কেমন হয়?"



ডিজিটাল টুইন 

মৃত্যুর পর সন্তানকে সঙ্গ দেওয়ার এই চিন্তা থেকেই 'মাইন্ড ব্যাংক এআই' নামের একটি স্টার্টআপ গড়ে তুলেন হিমেনেথ। যাদের লক্ষ্য, 'মানুষের জ্ঞান হারানো ও মৃত্যুর শৃঙ্খল ভাঙা—অন্তত আপনার আপনজনদের জন্য হলেও।' 

ট্রানসেনডেন্স (২০১৪)-র মতো অনেক হলিউড সিনেমাতে এ ধারণা বহুবার এসেছে। 


ধারণা একরকম হলেও এখানকার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। সিনেমায় সাধারণত দেখা যায় কোনো ব্যক্তির মস্তিষ্ক বা তার সমস্ত চেতনাই এআই হিসেবে আপলোড করে একটি ডিজিটাল সত্ত্বা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এই মাইন্ড ব্যাংকের ডিজিটাল টুইনটি গড়ে উঠবে আপনার সমস্ত ডাটা নিয়ে, যা সংগৃহীত হবে আপনার পুরো জীবনকাল ধরে। 


তারা এআইয়ের এমন এক মডেল তৈরি করতে চলেছে যেটি আপনার সমস্ত ডাটায় সজ্জিত হয়ে আপনার স্বরে আপনার মতো কথা বলতে পারবে, আপনার মতো হাসতে পারবে, হাসাতে পারবে, এবং আপনার মতো 'চিন্তা' করতে পারবে। আপনি মারা যাওয়ার পরই মূলত জীবন্ত হবে আপনার মাইন্ড ব্যাংকের এআই। 


এ মুহূর্তে একদম নিখুঁত ডিজিটাল টুইন নির্মাণ করার সক্ষমতা কারো নেই এবং শীঘ্রই সেটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবে সিরি, অ্যালেক্সার মতো আধুনিক ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসরগুলোর সক্ষমতা এবং ডিপফেক প্রযুক্তির হুবহু চেহারা ও অভিব্যক্তি নকল করার ক্ষমতা এই সম্ভাবনাকে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে কাছে নিয়ে এসেছে। 


কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং স্টার্টআপ ইতোমধ্যেই হিমেনেথদের মতো এআই তৈরি করেও ফেলেছে।


'রেপ্লিকা'র প্রতিষ্ঠাতা ইউজেনিয়া কুইদা তার প্রিয় বন্ধু রোমান মাজুরেঙ্কোর একটি ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করেছেন। বন্ধু মারা যাওয়ার পর শোকাচ্ছন্ন কুইদা বন্ধুর সব টেক্সট ঘাঁটা শুরু করেন। ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে রোমানের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে হওয়া সব কথোপকথন ও তার ছবিগুলোই ছিল কুইদার একমাত্র সম্বল।  

কুইদা সেসময় এক মেসেঞ্জার বট কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন। রোমানের ব্যক্তিগত ডাটা ব্যবহার করে তিনি এক বট তৈরি করেন যেটি তার বন্ধুর মতোই কথা বলতে সক্ষম।  

এই বট তৈরি করার আগে প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগেন কুইদা। বন্ধুকে এভাবে ফিরিয়ে আনাটা ঠিক হচ্ছে কি না, এটা চিন্তা করে একসময় দুঃস্বপ্নও দেখেছেন তিনি। 

এই দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে তার বন্ধুদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। রোমানের বটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে অনেক বন্ধুই। আবার অনেকে বন্ধুর সঙ্গে এভাবে যোগাযোগ করতে পেরেই খুশি। 

এদিকে মার্কিন প্রোগ্রামার জেমস ভ্লাহোসও তৈরি করেছেন একটি অনুরূপ বট। বাবার ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়লে ভ্লাহোস বাবার সবকিছু রেকর্ড করা শুরু করেন। সেসব তথ্য থেকেই পরবর্তীতে ভ্লাহোস তার ড্যাডবট (বাবার বট) তৈরি করেন। 

ভ্লাহোস এখন 'হিয়ার আফোটার এআই'-এর সিইও। তার কোম্পানি রেকর্ড করা সাক্ষাৎকার থেকে "লিগাসি এভাটার" ডিজাইন করে। এই এভাটার ব্যক্তি নিজেই তৈরি করেন। 

যে কারণে এ এভাটারের জীবন কাহিনী,  ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরণ, রসিকতা, প্রজ্ঞা ব্যক্তির কাছাকাছিই থাকে।

 বলতে গেলে এটি অ্যালেক্সা বা সিরির মতোই, কিন্তু এই এআই কথা বলবে আপনার আপনজনের স্বরে। 

এরকম অনেক কোম্পানিই ডিজিটাল টুইন নির্মাণের কাছাকাছি চলে এসেছে। এই স্টার্টআপগুলো সফল হলে অ্যামাজন, অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলোও প্রবেশ করবে এই বাজারে।

 

কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটায় একটি আদর্শগত দ্বন্দ্ব থেকেই যায়, এবং যাবে। 

যদি আমাদের মূল সত্ত্বার খুব কাছাকাছি এআই তৈরি করতে সক্ষম হয়ে যায় কোম্পানিগুলো, তাহলে আমরা কি আসলেই এদের বিশ্বাস করতে পারব? পারলে কোন কোন সিদ্ধান্তে পারব? তারা কি আমাদের শোক করতে সাহায্য করবে, না কি শোক কাটিয়ে উঠতে দিবে না? 

ডাটাগুলো আপনার, কিন্তু টুইনটা আপনি না 

আপনার ভার্চুয়াল টুইনকে গড়ে তোলা হবে ইন্টারনেটে (এবং কিছু ক্ষেত্রে বাস্তব জগতে) আপনার যত তথ্য আছে, সেগুলোকে সংগ্রহ করে। 

এখানে অবশ্যই ব্যক্তির গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ বা নৈতিক ভীতিটা হচ্ছে, এসব তথ্য বা ডাটায় একসময় আর আপনি থাকবেন না, এগুলো হয়ে উঠবে আপনার ডিজিটাল টুইন। 

মাইন্ড ব্যাংক এআই অবশ্য আগে থেকেই বলে নিয়েছে, ডিজিটাল টুইন মানেই 'আপনি' নন, এটি আপনার এক ধরণের প্রতিবিম্ব। এই টুইনকে আপনার ডাটায় প্রশিক্ষিত করা হবে; যে কারণে এটি আপনার মত কথা বলবে, হাসবে এবং ভাববে।


কিন্তু এটি আপলোড করা মস্তিষ্ক বা আপনার অস্তিত্বের ধারাবাহিকতার মতো কিছু না। এটি কখনোই আপনার মত বিকশিত হবে না, বা পরিবর্তিত হবে না। 


তাহলে এই ডিজিটাল টুইনকে কতটুকু বিশ্বাস করতে পারি আমরা? আপনি কি আপনার জীবনের শেষ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার জন্য পত্নীর ডিজিটাল টুইনের কথা বিশ্বাস করবেন? কোনো কোম্পানি ঝামেলায় পড়লে প্রতিষ্ঠাতার ডিজিটাল টুইনের পরামর্শ শোনা একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে; কিন্তু শুধু কবরের ওপাশ থেকে নয়, বরং মানবতার বাইরের একটি কণ্ঠস্বরকে কতটুকু মূল্য দিতে পারবেন আপনি? তাকে কি আপনি কোম্পানিতে একটি বোর্ড আসন এবং ভোটাধিকার দিবেন? 

আরও জটিল সমস্যা আছে। প্যাটার্ন বুঝার বেলায় এআই মানুষের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। হতে পারে, এআই  আপনার বক্তৃতা বা আপনার চিন্তা-ভাবনায় কোনো প্যাটার্ন খুঁজে পেল, যা আপনি জানেন না। এগুলো প্রয়োগ করে আরও সঠিক ডিজিটাল টুইন তৈরি করা সম্ভব, যেগুলো এক অর্থে আপনাকে আপনার চেয়েও ভালো চেনে। 

কিন্তু এই ডিজিটাল টুইনের এআই যদি কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্নে ভুল করে বসে, তাহলে আপনার সম্ভাব্য ডিজিটাল সংস্করণ স্বাভাবিকভাবেই বাস্তবের চেয়ে কিছুটা বিকৃত হবে।

একটি সাধারণ ডাটাই পুরো সিস্টেমকে নড়বরে করে দিতে পারে। এবং আপনজনের মনে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। ডিজিটাল টুইনের উপদেশ শুনে হয়তো আপনি ভাববেন, "দাদাজান কি আসলেই এ কথা বলত?" 


ডিজিটাল টুইনকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত অ্যালগরিদমগুলোও ভঙ্গুরতার মুখোমুখি হতে পারে, করে বসতে পারে যান্ত্রিক ত্রুটি। 


সামান্যতম ত্রুটি বা ভঙ্গুরতাও আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে। যে কারণে এই ডিজিটাল বন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারি আমরা। 


আবার এই ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তি যদি খুব সফল হয়, সেক্ষেত্রেও থাকছে ভয়। ডিজিটাল বন্ধুর সঙ্গে যদি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যাই, তাহলে কি আমরা কখনোই সেই ব্যক্তির বিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠতে পারব? 


হিমেনেথের জন্য এর উত্তর, 'হ্যাঁ'। হিমেনেথ বলেন, "শোকে আচ্ছন্ন হয়ে উঠলে আমরা সাধারণত ধর্মের দিকে মুখ ফেরাই। সেখানে আমরা এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, যেগুলোর জবাব হয়তো কখনোই পাই না।" 

কিন্তু আমরা যদি আপনজনের ডিজিটাল টুইনের পরামর্শ নিতে পারি? আপনার স্ত্রীর ডিজিটাল টুইন হয়তো আপনাকে বলবে, সময় এসেছে নতুন কাউকে খোঁজার। কিংবা আপনার যেসব প্যাশন ছিল, যেগুলোতে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করবে আপনাকে।

হিমেনেথ বলেন, "যদি সত্যিই আমরা (ওপার থেকে) কিছু উত্তর পাই, তাহলে সেটা দারুণ হবে না? 


"এটাই তো একমাত্র ভরসা, তাই না?"



সূত্র: বিগ থিংক

অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ 

Tbsnews



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال