ওসি প্রদীপের ফাঁসি চান কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের স্বজনরা।

ওসি প্রদীপের ফাঁসি চান কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের স্বজনরা। 

কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার চিংড়ি ব্যবসায়ী বাদশা ও তার ছেলে সাদ্দাম হোসেন। ২০২০ সালে পৃথক ঘটনায় টেকনাফ থানা পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় তাদের। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাবা-ছেলেকে বন্দুকযুদ্ধের নামে টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

ওসি প্রদীপের দাবিকৃত ২০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে না পারায় বাবা-ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ পরিবারের। 

এ ঘটনায় ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করে ভুক্তভোগী পরিবার। 


২০১৯ সালের ১৯ মার্চ মাসে বীজ ও সার আনতে উপজেলা সদরের কৃষি অফিসে গিয়েছিলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ। সেখান থেকে নূর মোহাম্মদকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। চাঁদা দিতে না পারায় ২১ মার্চ রাতে নূর মোহাম্মদকে সৈকতের ঝাউবাগানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম।


২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর একই ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা মো. আজিজ এবং স্থানীয় নুর হাসান ও আবুল খায়েরকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে মো. আজিজের পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। টাকা না দিলে আজিজকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এতে নিরুপায় হয়ে বিভিন্নভাবে ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে পুলিশকে দেয় আজিজের পরিবার। কিন্তু ১৯ অক্টোবর রাতে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া নদীঘাট এলাকায় আজিজকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে  আদালতে অভিযোগ দেন মো. আজিজের মা হালিমা খাতুন। পরে অভিযোগটি খারিজ করে দেওয়া হয়। 


২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহন হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর ওই বছরের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দ্বিতীয় আসামি করে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব

চার মাসের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।


গত বছরের ২৭ জুন ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর ২৩ আগস্ট কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং জেরা শুরু হয়। এ প্রক্রিয়া শেষ হয় গত ১ ডিসেম্বর। মোট ৬৫ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ১২ জানুয়ারি রায়ের জন্য ৩১ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন বিচারক।

এদিকে সিনহা হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে  ১৪৪টি কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৬১ জনকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। সব ঘটনায় মোটা অংকের চাঁদা দাবি ও প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।


ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ এনে ১৫টির বেশি মামলা করে নিহতদের পরিবার। কিন্তু মামলাগুলোর কোনো অগ্রগতি হয়নি। মামলাগুলোর অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ ভুক্তভোগীরা। তাই তারা সবাই চেয়ে আছেন সিনহা হত্যা মামলা রায়ের দিকে। 

ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিনহা হত্যার মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীদের বিচারের অপেক্ষা করছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের স্বজনরা। এর মধ্যে ৩১ জানুয়ারি সিনহা হত্যা মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা হলে তারা আশান্বিত হন। এই রায়কে ঘিরে টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের ঘরে ঘরে এখন প্রার্থনা চলছে। তারা নফল রোজা, নামাজসহ বিভিন্নভাবে ইবাদত করে ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের ফাঁসির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। 


ওসি প্রদীপের হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত যুবক বেলালের ভাই টেকনাফ সদরের হাবিবপাড়ার জালাল উদ্দীন বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীর তকমা দিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে আমার ভাইকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে গিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করেছিলেন ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। কিন্তু মামলা করেও আমি ভাই হত্যার বিচার পাইনি। তাই সিনহা হত্যা মামলার রায়ের দিকে চেয়ে আছি। 

তিনি বলেন, আমরা অধীর অপেক্ষায় রয়েছি, সিনহার হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের সবার ফাঁসি হবে। ভাইকে তো ফিরে পাব না, অন্তত তাদের ফাঁসি হলে আমরা সান্ত্বনা পাব। তাদের ফাঁসি হওয়ার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে কান্না করে প্রার্থনা করছি।  

কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জরপাড়ার যুবলীগ নেতা মুফিজ আলমের বাবা গোলাম আকবর বলেন, আমার ছেলেকে হত্যা করেছে ওসি প্রদীপ। ছেলেকে আর কখনো ফিরে পাব না। তার বিচারও পাব না হয়তো। কিন্তু এখন আমি চেয়ে আছি সিনহা হত্যা মামলার দিকে।  সিনহা হত্যা মামলায় আমাদের ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের ফাঁসি চাই আমরা। তাদের ফাঁসি হলে আমরা আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করব।


একই এলাকার নিহত সাহাব উদ্দীনের ছোট ভাই হাফেজ উদ্দীন বলেন, ওসি প্রদীপ টেকনাফকে নরকে পরিণত করেছিলেন। তার পাপের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার আল্লাহ আর সহ্য করেননি। আমরা যারা স্বজনহারা রয়েছি, তারা ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের বিচার চাইতে পারিনি। কিন্তু অলৌকিকভাবে তারা আজ বিচারের কাঠগড়ায়। তাদের ফাঁসিই হবে- আমরা এমন দোয়া করছি আল্লাহর কাছে।


সাইদুল ফরহাদ/আরএআর

DHAKAPOST / SOURCE

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال